Ads Area

মহাদেব সাহা’র সেরা কবিতা

 সব তো আমারই স্বপ্ন

.

সব তো আমারই স্বপ্ন মাথার উপরে এই যে কখনো

উঠে আসে মরমী আকাশ কিংবা স্মৃতি ভারাতুর চাঁদ

মেলে ধরে রূপকাহিনীর গাঢ় পাতা। কোনো এক

মহাদেব সাহা

কিশোর রাখাল কী করে একদা দেখা পেয়ে গেলো

সেই রাজকুমারীর আর পরস্পর ভাসালো গন্ডোলা।

সেও তো আমারই স্বপ্ন রূপময় এই যে ভেনিস

কী যে সিক্ত বাষ্পাকুল ছিলো একদিন রঙিন বর্ষণে

শিল্পের গৌরবে তার মুখচ্ছবি উদ্ভাসিত আর থেকে থেকে

জ্যোৎস্নখচিত সারা দেহে খেলে যেতো চিত্রের মহিমা!

এসব তো আমার স্বপ্নের মৃত শিশু এই যে কখনো

দেখি শৈশবের মতো এক স্মৃতির সূর্যাস্ত, অনুভূতিশীল মেঘ

যেন রাত্রি নামে নক্ষত্রের নিবিড় কার্পেটে

বুঝি যামিনী রায়ের কোনো সাতিশয় লোকজ মডেল।

সব তো আমারই স্বপ্ন তবে, মাঝে মাঝে উদ্যান, এভেন্যু,

লোকালয় মনে হয় অভ্রভেদী অব্যক্ত ব্যাকুল

এই গাছগুলি কেমন মিষ্টিক আর প্রকৃতি পরেছে

সেই বাউল বর্ণের উত্তরীয়! এও তো আমারই স্বপ্ন

আঙিনায় একঝাঁক মনোহর মেঘ

আর উন্মুক্ত কার্নিশে দোলে নীলিমা, নীলিমা! কিংবা

টবে যে ব্যাপক চারাগুলি তাতে ফুটে ওঠে মানবিকতার

রাঙা ফুল; এখনো যে কোনো কোনো অনুতপ্ত খুনী

রক্তাক্ত নিজের হাত দেখে ভীষণ শিউরে ওঠে ভয়ে

আর প্রবল ঘৃণায় নিজেই নিজের হাত ছিঁড়ে ফেলে

সেখানে লাগাতে চায় স্নিগ্ধ গোলাপের ডালপালা।

সেও তো আমারই স্বপ্ন এই যে চিঠিতে দেখি

ভালোবাসারই তো মাত্র স্বচ্ছ অনুবাদ কিংবা

একটি কিশোরী এখনো যে বকুলতলায় তার

জমা রাখে মৃদু অভিমান; এখনো যে তার গণ্ডদেশ

পেকে ওঠে পুঞ্জীভূত মাংসের আপেল। এসব তো

আমার স্বপ্নের মৃত শিশু, বিকলাঙ্গ, মর্মে মর্মে

খঞ্জ একেবারে! যেন আমি বহুকাল-পোষা

একটি পাখির মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে আছি।

আমি জানি সবই তো আমার স্বপ্ন নীলিমায়

তারার বাসর আর এভেন্যুতে গূঢ় উদ্দীপনা-

এইগুলি সব তো আমারই স্বপ্ন, সব তো আমারই স্বপ্ন।


মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

.

কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস

নিয়ে বেড়ায়-

কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,

এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি

অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!

পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ

আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!

দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল

আর কোথাও নেই,

এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!

একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে

বেড়ায়, কেউ জানে না

হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে

কিংবা যদি

প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,

তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে

গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে

মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।

তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস

চেপে রাখে

তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;

মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে

কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ

মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস

আর আহত সভ্যতা

মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক

দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে

মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;

একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে

বেড়ায়, কেউ জানে না

একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে

বেড়ায়, কেউ জানে না

একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,

হায়, কেউ জানে না!




ভালোবাসা আমি তোমার জন্য

.

ভালোবাসা আমি তোমাকে নিয়েই

সবচেয়ে বেশি বিব্রত আজ

তেমাকে নিয়েই এমন আহত

এতো অপরাধী, এতো অসহায়!

তোমাকে নিয়েই পালিয়ে বেড়াই

তোমাকে নিয়েই ব্যাকুল ফেরারী।

ভালোবাসা তুমি ফুল হলে তার

ফুলদানি পেতে অভাব ছিলো না,

মেঘ হলে তুমি সুদূর নীলিমা

তোমাকে দিতাম উড়ে বেড়াবার;

জল হলে তুমি সমুদ্র ছিলো

তোমারই জন্য অসীম পাত্র-

প্রসাধনী হলে তোমাকে রাখার

ছিলো উজ্জ্বল অশেষ শো-কেস,

এমনকি তুমি শিশির হলেও

বক্ষে রাখার তৃণ ছিলো, আর

সবুজ পাতাও তোমার জন্য

হয়তোবা হতো স্মৃতির রুমাল।

ভালোবাসা তুমি পাখি হতে যদি

তোমাকে রাখার ভাবনা কি ছিলো

এই নীলকাশ তোমারই জন্য

অনায়াসে হতো অনুপম খাঁচা!

কিন্তু তুমি তো ফুল নও কোনো

মেঘ নও কোনো দূর আকাশের,

ভালোবাসা তুমি টিপ নও কোনো

তোমাকে কারো বা কপালে পরাবো;

ঘর সাজাবার মেহগনি হলে

ভালোবাসা তুমি কথা তো ছিলো না

তুমি তো জানোই ভালোবাসা তুমি

চেয়েছো মাত্র উষ্ণ হৃদয়!

খোঁপায় তোমাকে পরালেই যদি

ভালোবাসা তুমি ফুটতে বকুল,

কারো চোখে যদি রাখলেই তুমি

হতে ভালোবাসা স্নিগ্ধ গোধূলি-

তাহলে আমার তোমাকে নিয়ে কি

বলো ভালোবাসা এমন দৈন্য,

আমি তো জানিই তোমার জন্য

পাইনি যা সে তো একটি হৃদয়

সামান্যতম সিক্ত কোমল,

স্পর্শকাতর অনুভূতিশীল!



আমার সমুদ্র দেখা, আমার পাহাড় দেখা

.

আমার কোনোদিন সমুদ্রদর্শন হয়নি, পাহাড় দেখাও না

কেন যে সমুদ্র বা পাহাড় আমাকে এমন বিমুখ করেছে

সমুদ্র আমাকে দর্শন দেননি কখনো

পাহাড় আমাকে সান্নিধ্য,

বাল্টিকের তীরে দাঁড়িয়ে আমি যেমন ধু-ধু জলরাশি ছাড়া

কোনো সমুদ্রই দেখতে পাইনি আর

তেমনি ময়নামতির পাহাড়েও প্রস্তরীভুত নিস্তব্ধতা,

এই আমার পাহাড় কিংবা সমুদ্রদর্শন!

হয়তো সমুদ্র দেখতে গিয়েই আমার তখনই

মনে পড়ে যায় একটি নিঃসঙ্গ চড়ুই কিংবা কাকের করুণ মৃত্যু

কিংবা মাতিসের কোনো নীল চোখের দিকে তাকিয়েই মনে হয়

সমুদ্র

কখনো কপালকুণ্ডলার আখ্যান জুড়েই উচ্ছল হয়ে ওঠে

নীলফেনিল তরঙ্গমালা!

কিন্তু আমি তো সমুদ্রই দেখতে চেয়েছিলাম তবুও সমুদ্রের কাছে গিয়ে

আমার কখনো সমুদ্র দেখা হয়নি

যেমন পাহাড়ের কাছে গিয়ে দেখা হয়নি কোনো নিবিড় পাহাড়কে,

আমি সেখানে উচ্চতা ছাড়া পাহাড় বলতে কিছুই দেখিনি!

এই সমুদ্র আমাকে চিরদিন বিমুখ করেছে

সমুদ্রের গায়ে হাত রেখে তাই তাকে

কেমন আছে বলে কুশল প্রশ্ন করতে পারিনি কখনো,

যতোবারই তাকিয়েছি ততোবারই মনে হয়েছে ব্যর্থতা

এক অর্থে এই ব্যর্থতার নামই সমুদ্র কিংবা পাহাড়;

পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে ঈশ্বর জানেন কোথায় যেন কি

মিল আছে

হযতো তাই পাহাড়কে কখনো আমার মনে হয়েছে তরঙ্গময়

সমুদ্রকে শিলাশোভিত;

আমি হয়তো সমুদ্রের মধ্যে আরো কোনো পৃথক সমুদ্র সন্ধান

করেছিলাম কি না কে জানে

পাহাড় কিংবা আকাশের দিকে তাকিয়েও ঠিক তেমনি

অন্য কোনো স্বপ্ন-কোনো আভাস

তাই এখন কেবল মনে পড়ছে বাল্টিক কিংবা আরব সাগরের কূলে

আমি একটিও ঝিনুক কিংবা শঙ্খ কুড়াইনি কখনো

ক্যামেরায় সমুদ্রের ছবি তোলার দুঃসাহস করবো কীভাবে

সমুদ্রের কাছ থেকে আমি উপহার পেয়েছিলাম সামান্য যা টাকাকড়ি

তার নাম ব্যর্থতা;

চিরকাল পাহাড় ও সমুদ্রদর্শন করতে গিয়ে

আমার লাভের মধ্যে এই কিছু পবিত্র বিষাদ অর্জন!

তাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমার সমুদ্রদর্শন হয়নি

পাহাড় দেখতে গিয়ে পাহাড় দেখা,

না দেখেছি পাহাড় না দেখেছি সমুদ্র

অথচ কী যে দেখতে দেখতে কী যে দেখতে দেখতে

আমার কতোবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে

হয়তো আমি কিছুই দেখিনি সেই না-দেখাটাই ছিলো আমার

সমুদ্রদর্শন, আমার পাহাড়-প্রবেশ।

সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে কখন মনে পড়েছে

আমার মায়ের অশ্রুভেজা দুটি চোখ

সমুদ্রকে তার সেই সিক্ত ও সজল চোখের চেয়ে বিস্তৃত মনে

হয়নি আমার,

যে চোখ এতো অশ্রু ও মমতা ধারণ করে আছে তার দিকে তাকিয়েই

আমি বলেছি এই তো সমুদ্র!

হতে পারে সমুদ্রকে এভাবেই আমি ভিন্ন ও পৃথক রূপে দেখে

ভীত ও শিহরিত হয়েছিলাম।

আবার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতেই আমার কখন যে

বাংলাদেশের একজন ক্ষুধার্ত কিশোরীর মলিন ছেঁড়া শাড়ির কথা

মনে পড়ে যায়, বলতে পারবো না

আকাশের চেয়ে তার দারিদ্র্যকেই বেশি বড়ো মনে হয় আমার

আমি কি করবো, সমুদ্র দর্শনের ঠিক একাগ্রতাই হয়তো আমার নেই

কিংবা আকাশ কি পাহাড় দেখার সঠিক মনোযোগ,

তাই সমুদ্র দেখতে দেখতে আমার মধ্যে জেগে ওঠে সামান্য একটি

চড়ুইয়ের মৃত্যুদৃশ্য

আকাশ দেখতে দেখতে আমার মনে হয় আমি বুঝি

সারা বাংলাদেশ জুড়ে কেবল বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ি টানানো দেখছি,

পাহাড় দেখতে গিয়ে কতোবার যে আমি এমনি আহত হয়ে

ফিরে এসেছি

সকলে সুদৃশ্য পাহাড় দেখলেও আমি সেসবের কিছুই দেখিনি।

তাই এসব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে বললে

তখনই কেবল চোখের সামনে পাহাড় ও অকূল সমুদ্র

ভেসে ওঠে

চোখের জলই আমার মনে হয় সমুদ্র

অটল মৌনতাই আমার কাছে পাহাড়;

কিন্তু সমুদ্রের সেই পৃথক সুন্দর রূপ আমি স্পষ্ট দেখতে পারিনি কখনো

তাই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বারবার আমি দেখেছি জলের দম্ভ

অনেকটা মরুভূমির মতোই শূন্য ও ধূসর সে, এখানেই তো

বালিরও উদ্ভব

পরক্ষনেই সমুদ্রে জাহাজগুলোকে ভাসতে দেখে

আমার মনে হয়েছে অনন্তের মধ্যে সাঁতার কাটছে তোমার রাজহাঁস,

মাছগুলো এই সমুদ্রের রহস্যের মতোই লাল ও উদাসীন

সূর্যাস্ত আর গোধূলিও যেন এই সুমদ্রের মধ্যেই শুয়ে আছে!

কখনো এই সমুদ্রের মধ্যেই আমি দেখেছি জ্বলজ্বল করছে

অসংখ্য তারা, চাঁদ ভাসছে সমুদ্রে

হঠাৎ সমুদ্রের মধ্যে এই নীলাকাশ দেখে

আমি কেমন বিহ্বল ও অনুতপ্ত হয়ে পড়ি;

আর আমার সমুদ্র দেখা হয় না, সমুদ্রের কলতান

আমার কাছে মনে হতে থাকে তোমার ব্যাকুল আহ্বান যেন,

তাই কেউ যখন পাহাড়ের উচ্চতা মাপতে যায়

আমি তখন মৌনতা বিষয়ে ভাবতে থাকি।

আমি হয়তো সমুদ্রে ঠিক সমুদ্র দেখতে পাই না

পাহাড়ে ঠিক পাহাড়,

হয়তো সমুদ্রের চেয়েও কিছু বেশি পাহাড়ের চেয়েও কিছু অধিক

আমি সেই সমুদ্র ও পাহাড়কেই হয়তো নাম দিতে চাই কবির তন্ময়তা।



আমার হাতে দুঃখ পাচ্ছো

.

আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আঘাত দেওয়ার

কথা ছিলো না, কথা ছিলো না, কথা ছিলো না,

তোমাকে আমার আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, গোলাপ তোমার

খুনখারাবি, হত্যাকাণ্ড এসব আমার একটু সয় না

গোলাপ তোমায় আঘাত দেওয়ার নিষ্ঠুরতা ঠিকই আমি করতে

চাইনি

আমি বড়ো কোমল ছিলাম, গোলাপ তোমার মতোই

আমি কোমল ছিলাম

আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, আমি কবি, আমি

কোনো নিষ্ঠুরতা দেখতে চাইনি, করতে চাইনি

নারী তুমি কাঁদবে আমার সহ্য হয় না, গোলাপ তুমি কাঁদবে আমার

সহ্য হয় না, মানুষ তুমি দুঃখ পাবে সহ্য হয় না

আমি কবি বলে আমি যীশুর মতোই কোমল ছিলাম, শুদ্ধ ছিলাম

আমার কাউকে আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না, মানুষ তোমাদের

আঘাত দেওয়ার কথা ছিলো না

গোলাপ তোমায় ভ্রষ্ট করার, নারী তোমায় নির্যাতনের

মানুষ তোমায় দুঃখ দেওয়ার আমার মোটেই কথা ছিলো না

তবুও তোমরা আমার হাতে, নারী তুমি আমার হাতে

গোলাপ তুমি আমার হাতে

সবচেয়ে কঠিন আঘাত পাচ্ছো, দুঃখ পাচ্ছো।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ads Area